ছায়াপথ দেব গোপাল মণ্ডল ও তাঁর টিমের এমন এক প্রয়াস যা দর্শককে বিশেষ ভাবে সমৃদ্ধ করে !
ছবিঃ ছায়াপথ
কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও পরিচালনাঃ দেব গোপাল মণ্ডল।
চিত্রগ্রাহকঃ তনয় রায়।
সম্পাদনাঃ উজ্জ্বল মুখার্জী।
সৃজনঃ সিদ্ধার্থ শঙ্কর।
অভিনয়: বিদিশা চক্রবর্ত্তী, বিবেক নন্দী, বিজয় কুমার দাস
লিপিকা সরকার, বৃষ্টি ও সুমিত।
কন্ঠঃ মিঠু চক্রবর্তী, তনিমা দাস সরকার।
গত উনিশে অক্টোবর “মহুল ইন্টারন্যাশান্যাল ফিল্ম ফ্যাস্টিভ্যাল” এ দেশ বিদেশের সাতটি ছোট ছবির সাথে “স্পেশাল স্ক্রীনীং” বিভাগে ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয়ে গেলো দেব গোপাল মণ্ডলের ছোট্ট ছবি “ছায়াপথ”। পৃথিবী জুড়ে বাড়তে থাকা পরিবেশ দুষন ও নারী নির্যাতন এই ছবির মুল বিষয় বস্তু। অমল (বিবেক নন্দী) একজন প্রতিষ্ঠিত ফটোগ্রাফার নারী আর প্রকৃতি নিয়ে ফটোস্টোরি করতে বেশ কয়েক বছর পর গ্রামে আসে। মডেল তাঁর ছোট বেলার বন্ধু সুধা (বিদিশা চক্রবর্ত্তী); যে তাঁর অসুখের সময় রোজ ফুল দিয়ে যেত। কিন্তু সুধা তাতে রাজি নয় কারণ তাঁর মতো মোটা চেহারার কেউ নাকি মডেল হয়না। বিজ্ঞাপণ কোম্পানির ঠিক করে দেওয়া সৌন্দর্যের মাপকাঠির বিরুদ্ধেও অমল কাজ করতে চায়।সুধা তাতে রাজী নয় কারণ এ অনেক পুরোনো কালচার যে কারনে দুর্গা লক্ষ্মী সরস্বতীদের বয়েস বাড়েনি, আবার কালী মনসা গায়ের রঙ, পোষাক কালচারের জন্য স্বর্গে জায়গা পায়নি। কিন্তু অমলের অদম্য জেদের কাছে হার মানে সুধা। শুরু হয় ফটোস্টোরি ‘মনসা-যিনি বিষহরী অর্থাৎ সারা বিশ্বের বিষ হরণ করেন আজ তাঁর শরীরে বিষ জল দুষনের জন্য এমনকি তাঁর অসুস্থ শরীর নিয়ে ভেসে যাওয়া ভেলার গতিও আঁটকে গেছে প্লাস্টিক বোতল প্যাকেটে। কালো চামড়ার সরস্বতীর মাধ্যমে বর্ণ বৈষম্য এবং পেপারের জন্য গাছ কাটা আর সেই পেপারেই লেখা “সেভ ট্রী” মতো হিপোক্রেসিও উঠে এসেছে। উঠে এসেছে দামী মুল্যবান গাছের মতোই অসহায় মেয়েরা কেমন পাচার হয়ে যাচ্ছে সবার অলক্ষ্যে। ছবির শেষ ফটোস্টরিতে উঠে এসছে ধর্ষিতা নারীর মতো কেমন করে মানুষের স্বার্থের কাছে পৃথিবী অসহায়, ক্লান্ত। এরই মাঝে অমল সুধাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে সুধা তা অস্বীকার করে এবং উপেক্ষা করে চলে যায়। অমল ফিরে যাবার সময় গ্রামের বিশুকাকার কাছে জানতে পারে আসল কারণ, সুধা অসুস্থ, পুরুষের লোভের শিকার সে এবং তাঁর শরীরে এইচআইভির জীবানু বাসা বেঁধেছে। সকল সামাজিক ট্যাবুকে উড়িয়ে দিয়ে সারা জীবনের জন্য বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় অমল।
মাইথোলজিক্যাল যুগ থেকেই চলে আসা নারী ও প্রকৃতির ওপর পুরুষ ও ক্ষমতার দখল রাজনীতি, সেখান থেকে শুরু করে এইচআইভি সচেতনতা ইত্যাদি মাত্র কুড়ি মিনিট দৈর্ঘের এই ছবিতে বেশ সাবলীল চিত্রনাট্য ও বলিষ্ঠ সংলাপে তুলে ধরেছেন দেব গোপাল। আর তার জন্য বিভিন্ন রবীন্দ্র চরিত্রকে আশ্রয় করেছেন; ধার নিয়েছেন ‘ডাকঘর” এর বহু সংলাপ, রবিন্দ্রনাথের কবিতা গান ইত্যাদি। ডাকঘরের মতো জনপ্রিয় নাটকের সুধাকে বেশ মোটা লুকে পর্দায় তুলে আনা, জানালার ধারে বসে অসুস্থ সুধার ‘ডাকঘর’ পড়া কিম্বা সুধার জানালায় আসা মাঝ বয়েসি নন্দিনীদির নাইলন ব্যাগে ছাতা আর প্লাস্টিক বোতল নিয়ে ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে যাওয়া বেশ বিতর্কিত কাজ। আবার নন্দিনীর মুখে শোনানো দইওয়ালার গ্রামের পাহাড় ভেঙে কয়লা উঠবে সেখানের ঝর্ণার জলে গেট বসছে কারেন্ট তৈরী হবে। জানতে পারে রঞ্জনের যক্ষার আরো অবনতির কথা; রঞ্জন-নন্দিনীর মেয়ে করবীর লাঙ্স ক্যান্সার হয়েছে ফ্যাক্টরির ধোঁয়ায়; বা বৃদ্ধ বিশুকাকা অন্য কোথাও অন্য কোন মানুষের শোকে গান গাইছে ইত্যাদি ইত্যাদি সুত্র ধরে যেভাবে গল্প এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন তাতে বেশ সাহসিকতা লাগে আর পরিচালক তা বেশ দক্ষতার সাথেই করেছেন। তবে এই ছবির অভিনয় আরো বলিষ্ঠ হতে পারত যা বেশ কিছু জায়গায় দর্শককে আশাহত করে। তনয় রায়ের ক্যামেরার কাজ ভালো হলেও বেশ কিছু জায়গায় আরো যত্নশীল হওয়া উচিৎ যেতো। কিন্তু উজ্জ্বল মুখার্জীর সম্পাদনা এই ছবির গতিকে ধরে রাখে। এই ছবির আরেক বড় সম্পদ সিদ্ধার্থ শঙ্করের শিল্প নির্দেশনা ও মাইথোলোজিক্যাল চরিত্রগুলির রূপসজ্জা, যা বিশেষ ভাবে গল্পের দাবি মেনেই দর্শককে ধরে রাখে। “ফীল-মী-ফ্রেম” এর উদ্যোগে “গ্রন্থনা”র বিশেষ সহযোগিতায় “ফীল্ম ও কাহিনী” প্রথম নিবেদন “ছায়াপথ” দেব গোপাল মণ্ডল ও তাঁর টিমের এমন এক প্রয়াস যা দর্শককে বিশেষ ভাবে সমৃদ্ধ করে এবং ভবিষ্যতের ভালো ছবির আশাকে জিইয়ে রাখে। কিছু যান্ত্রিক ত্রুটি ও দুর্বলতা থাকলেও অভিনব বিষয় বস্তুর জন্য এ ছবি দেখায় যায়।






