লৌহমানব সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের ১৪৬তম জন্মবার্ষিকী: আপোষহীন এই রাজনীতিকের স্মৃতি তর্পণ করছে গোটা দেশ

 

‘সন্দেহ নেই যে, আমার পসার এখন বেড়ে চলেছে।
আমার টাকা কাল শেষ হয়ে যাবে, আমার যারা উত্তরাধিকারী, তারাই এই টাকা উড়িয়ে দেবে। বরং তাদের জন্য টাকার চেয়ে আরও ভালো একটি উত্তরাধিকার আমি রেখে যেতে চাই। ’ -সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল।

যাঁকে ‘ভারতের লৌহমানব’ বা ‘দ্য আয়রনম্যান অফ ইন্ডিয়া’ বলে ডাকা হয়, যাঁর জন্মদিবস পুরো ভারতে ‘রাষ্ট্রীয় একতা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়, গান্ধীজীর একটি আদেশে যিনি অখণ্ড ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন, তিনি ভারতের সর্বকালের অন্যতম মহান রাজনীতিবিদ সর্দার বল্লভভাই জাভেরভাই প্যাটেল। সংক্ষেপে সর্দার প্যাটেল। ভারতের প্রথম উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। পরাধীন ভারতে গুজরাটের এক সম্ভ্রান্ত কুর্মী পরিবারে বল্লভভাই প্যাটেল জন্মগ্রহণ করেন। বাবা জাভেরভাই প্যাটেল ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মীবাঈয়ের সেনাবাহিনীতে কিছুদিন সার্ভিস দিয়েছিলেন এবং মা লাডবাঈ ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক তপস্বিনী মহিলা। বাবা-মায়ের সূত্রেই বল্লভভাই প্যাটেল অধিকারী হয়েছিলেন একটি প্রগাঢ়, শীতল এবং আপোষহীন ব্যক্তিত্বের।

আজ ৩১ অক্টোবর। লৌহ মানব সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের ১৪৬ তম জন্মবার্ষিকী। সারা দেশ জুড়ে পালিত হচ্ছে তাঁর জন্মবার্ষিকী। দেশের একতা রক্ষার্থে তার বিশেষ ভূমিকা ছিল। তাই আজকের এই দিনটিকে রাষ্ট্রীয় একতা দিবস হিসেবেও পালন করা হয়।

১৮৭৫ সালের ৩১ শে অক্টোবর গুজরাতে কুর্মী পরিবারে তাঁর জন্ম। বাড়িতেই শুরু হয় তার প্রাথমিক শিক্ষা। গুজরাটি স্কুলে কিছুদিন পড়ার পর সেখান থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তাকে ভর্তি করা হয় একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। সেখানে পড়ার সময় ১৮৯১ সালে মাত্র ষোল বছর বয়সে জাভেরবেন নাম্নী এক মেয়ের সাথে তার বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিয়ের প্রায় ছয় বছর পরে ২২ বছর বয়সে সর্দার প্যাটেল ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯১১-তে প্রিয়পত্নী জাভেরবেন প্যাটেল পঞ্চবর্ষীয় কন্যা মনিবেণ এবং ত্রিবর্ষীয় পুত্র দয়াভাইকে রেখে দেহত্যাগ করলে বল্লভভাই প্যাটেল মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়েন। স্বপ্ন ছিল আইন নিয়ে অধ্যয়ন করার। জমানো টাকা নিয়ে ৩৬ বছর বয়সে পাড়ি দেন ইংল্যান্ডে। লন্ডনের ‘মিডল টেম্পেল ইন’ থেকে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন। পূর্বের কলেজের ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকা সত্ত্বেও প্যাটেল তার ক্লাসে শীর্ষ স্থান অধিকার করেন। ৩৬ মাসের কোর্সটি তিনি সম্পন্ন করেন ৩০ মাসে। পরবর্তীকালে ভারতে এসে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ভারতের প্রথম উপ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাজ শুরু করেন।

১৯১৭ সালে সর্দার প্যাটেল স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে যোগ দেন।রাজনীতিতে তার একদম আগ্রহ ছিল না। গান্ধীজীর এক সভায় তার স্বাধীনতা আন্দোলনের পদ্ধতির উপহাস করে বল্লভভাই তার বন্ধু বিখ্যাত উকিল গণেশ বাসুদেব মাভলানকারকে বলেছিলেন, “গান্ধীজীর কথায় স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা আর চাল থেকে কাঁকর বাছা একই কথা!”

১৯১৮ -তে গুজরাটের কায়রায় ভয়াবহ বন্যায় কৃষকগোষ্ঠী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্রিটিশ সরকার বন্যার বিষয়টি মাথায় না নিয়েই কায়রার কৃষকদের ওপর করারোপ করে। কৃষকরা ‘কর দেব না’ আন্দোলন শুরু করলে পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করে।ব্রিটিশ সরকার কৃষকদের জমি কেড়ে নেওয়া শুরু করলে বল্লভভাই ছুটে যান কায়রায়। কায়রার কৃষকদের সংগঠিত করে বিশাল ‘কর শুল্ক অভিযান’ পরিচালনা করেন। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশরাজ নত হয় এবং কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দেওয়া শুরু করে। কায়রার কৃষকরা বল্লভভাইকে ‘সর্দার’ (যার অর্থ নেতা) উপাধি প্রদান করে।

১৯২০ সালে গুজরাট কংগ্রেসের সভাপতি হন। গুজরাটের খেদায় প্লেগে আক্রান্ত হাওয়ায় দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। নিজের ক্যারিয়ারের কথা না ভেবে নেমে পড়েন ত্রাণ সংগ্রহে।

১৯২৩ সালে গান্ধীজী ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলন শুরু করলে সর্দার প্যাটেল সে আন্দোলনেও সর্বাত্মকভাবে অংশগ্রহণ করেন।মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন কে সমর্থন করে শুরু করেন খাদি পরা। এই আন্দোলনে তিন লাখের বেশি সদস্য এবং প্রায় পনের লক্ষ টাকা দলের তহবিলে সংগ্রহ করার জন্য ভ্রমণ করেন পশ্চিম ভারতে। এরপর ধীরে ধীরে তিনি জাতীয় কংগ্রেসের নেতা হয়ে ওঠেন।

১৯৩১ সালে গান্ধীজীর সাথে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড আরউইনের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যেটি ইতিহাসে ‘গান্ধী-আরউইন চুক্তি’ নামে খ্যাত। সেই চুক্তির একটি শর্ত ছিল গান্ধীজী তার অনুসারীদের আন্দোলন থামাতে বলবেন এবং সরকার সকল রাজবন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তি দেবে। চুক্তির আওতায় সর্দার প্যাটেলসহ অনেক রাজবন্দী মুক্তি পেয়েছিলেন।

১৯৩৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি কংগ্রেসের পক্ষে ভারতজুড়ে প্রচারণা চালিয়েছিলেন যদিও নিজে কোনো আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। সভাপতি হওয়ার পরে অনেক বিষয়েই কংগ্রেসের আধিকারিকদের সাথে তার মতপার্থক্য দেখা দিতে থাকে। অনেকের ওপর তিনি বিরক্ত হতেন। কংগ্রেসের রাজনৈতিক আদর্শে সমাজতন্ত্র ঢুকানো হলে তিনি জওহরলাল নেহেরু ওপর যারপরনাই বিরক্ত হন। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সাথে গান্ধীজীর মতভেদ এবং মনোমালিন্য হলে প্যাটেল তাকে ‘ক্ষমতালোভী’ আখ্যা দিয়েছিলেন এবং এর ফলে যথেষ্ট সমালোচিতও হয়েছিলেন।

১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় ব্রিটিশদের হাতে গ্রেপ্তার হন প্যাটেল। আহমেদনগরের দুর্গে বন্দী ছিলেন।তিন বছর কারাভোগের পরে ১৯৪৫ সালে তারা মুক্তি পেয়েছিলেন।

স্বাধীনতার পরে তিনি ভারতের প্রথম উপ প্রধানমন্ত্রী হন এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। মন্ত্রী হিসেবে তিনি স্টেটস ডিপার্টমেন্ট এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। পাঞ্জাব ও দিল্লী থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা ও শান্তি পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু করেন তিনি। তবে সর্দার প্যাটেলের এই অমূল্য পরিষেবাগুলি স্বাধীন ভারতের কাছে মাত্র তিন বছরের জন্য স্থায়িত্ব ও উপলব্ধ ছিল। ১৯৫০ সালের ১৫ ই ডিসেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি।

মৃত্যুর পরে তাঁকে ভারতরত্ন সম্মান দেওয়া হয়। প্যাটেলকে শ্রদ্ধা জানাতে ২০১৪ সালে সূচনা হয় রাষ্ট্রীয় একতা দিবসের। প্রত্যেক বছর তাঁর জন্ম বার্ষিকীতে পালন হবে এই একতা দিবস এবং তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে গুজরাটে স্থাপন করা হয় ‘স্ট্যাচু অফ ইউনিটির’। যার উচ্চতা ৫৯৭ ফুট।

সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল পরিচিত ‘আয়রন ম্যান অফ ইন্ডিয়া’ হিসেবে। তিনি ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম পুরোধা। মহাত্মা গান্ধী জেলে থাকার সময় সত্যাগ্রহ আন্দোলনকে সারা ভারতজুড়ে পালন করেছিলেন তিনি। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ছিলেন ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। স্বাধীন ভারতে ৫৬৫ টি রাজ্যকে একীকরণ এর পেছনে তাঁর অবদান বিস্মরনীয়। পর্তুগীজদের হাত থেকে গোয়া এবং নিজামদের হাত থেকে হায়দ্রাবাদকে উদ্ধার করে ভারত সরকারের সাথে যুক্ত করেন তিনি। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে নেহেরু ‘নতুন ভারতের নির্মাতা ও একীকরণকারী’ বলে অভিহিত করেছিলেন। সেই থেকেই তিনি লৌহ মানব নামে পরিচিত।

Facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmail

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *