ঘুরে দেখুন অকল্যান্ড সার্কাস গার্ডেন বা ইডেন উদ্যান বা ইডেন গার্ডেন পার্ক!
বন ধ্বংসের ফলে বিশ্বজুড়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য আজ দারুণ ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। আবহাওয়ার অস্বাভাবিক পরিবর্তন হয়েছে। ভবিষ্যত প্রজন্ম ও মানব-সভ্যতা রক্ষার জন্যই আরও বেশি করে আমাদের গাছ লাগানো প্রয়োজন। যত বেশি পরিমাণে গাছ লাগাতে পারব, তত বেশি আমরা সবুজের সঙ্গে একাত্মতা বাড়াতে পারব।
আজ বলব সবুজের সমারোহে মিলেমিশে একাকার হওয়ার মতো একটি গাছ-গল্প। খোদ কলকাতার বুকেই রয়েছে এই সুন্দর সবুজ-দ্বীপ।যেখানে দু-দন্ড বসে আপনি নিজের এবং প্রকৃতি দুই-এর সঙ্গেই এক অন্য আলাপচারিতায় মেতে উঠতে পারবেন।আর এই গাছ-গল্পের নাম হল’ অকল্যান্ড সার্কাস গার্ডেন বা ইডেন উদ্যান।
কীভাবে পৌঁছবেন: এসপ্ল্যানেড মেট্রো থেকে আকাশবাণীর দিকে মিনিট পাঁচ হাঁটলেই বাঁদিকে ইডেন গার্ডেন দেখতে পাবেন। যা আমরা সকলেই চিনি। সেই রাস্তা দিয়েই সোজা আরো ৪-৫ মিনিট মত হাঁটলেই পৌঁছে যাবেন ইডেন উদ্যানে। চক্ররেলেও এখানে আসা যায়, তবে, তুলনায় এর সংখ্যা অনেক কম। তাই বাবুঘাটগামী যেকোনো বাসে উঠে এখানে পৌঁছনো অনেক বেশি সহজ হবে এবং সময়ও বাঁচবে। ইডেন গার্ডেন স্টেডিয়ামের একদম গায়েই এই ইডেন গার্ডেন পার্ক বা ইডেন উদ্যান।প্রবেশ মূল্য লাগবে মাত্র কুড়ি টাকা।
কিছু তথ্য : এই ইডেন উদ্যানের একটা খুব সুন্দর ইতিহাস রয়েছে। জর্জ ইডেন, অকল্যান্ডের ১ম আর্ল, যিনি লর্ড অকল্যান্ড নামে বেশি পরিচিত।১৮৩৬ থেকে ১৮৪২ সাল পর্যন্ত ভারতের গভর্নর জেনারেল হিসেবে লর্ড অকল্যান্ড দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে বোন এমিলি এডেন ভারত ভ্রমণে এসে এখানেই থাকতে শুরু করেন। কলকাতা এই সময় ছিল ভারতের রাজধানী। বোনেদের মধ্যে, এমিলি ছিলেন বিখ্যাত পর্যটক ও লেখিকা। তাঁর দেশকে জানার আগ্রহ এত বেশি ছিল যে, তিনি সেইসময়ের কলকাতার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা করে নানা রকম তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর লেখা আপ দ্য কান্ট্রি : লেটারস রিটেন টু হার সিস্টার ফ্রম দ্য আপার প্রভিন্সেস অফ ইন্ডিয়া (১৮৬৭) ভলিউমে এ সবকিছু সংগৃহীত রয়েছে। বাগানের প্রতি তাঁর জন্মগত ভালোলাগা এবং ভালোবাসা ছিল। বোন এমিলির কলকাতায় থাকাকালীন লর্ড অকল্যান্ডের উদ্যোগে ইডেন গার্ডেনের কাজ শুরু হয়। ১৮৪০ সালে তৎকালীন সিভিল আর্কিটেক্ট ক্যাপ্টেন ফিটজেরাল্ডের তত্ত্বাবধানে গার্ডেনের কাজটি সম্পূর্ণ হয়। নাম রাখা হয় অকল্যান্ড সার্কাস গার্ডেন। পরে এডেন সিস্টার্সদের স্মরণে এর নামান্তর করা হয়। এরপরই ইডেন গার্ডেন বা ইডেন উদ্যানটি আনুষ্ঠানিকভাবে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
এই বাগানের মধ্যে রয়েছে একটি BURMESE PAGODA। বাগানের ঠিক উত্তর অংশে এটি দাঁড়িয়ে আছে, যা এই উদ্যানের মূল আকর্ষণ। একটি পুকুর বা জলাশয়ের, জলরাশি দ্বারা বেষ্টিত। ঠিক যেন একটা দ্বীপের মতো। প্যাগোডা, মূলত মায়ানমার বা পূর্ববর্তী বার্মার অন্তর্গত, এরও একটি গল্প রয়েছে।এই প্যাগোডার কাঠামোটি ১৮৫২ সালে বার্মার প্রোমের (বর্তমানে যার নাম মায়ানমার-এর প্যায় PYAY) গভর্নর মং হননের বিধবা মা কিন নির্মাণ করেছিলেন। প্যাগোডার মূল কাঠের কাজের আনুমানিক খরচ হয়েছিল ১৫০০টাকা এবং বলা হয় যে এটি সম্পূর্ণ হতে তিন মাস সময় লেগেছিল। প্যাগোডাটি একটি ‘তাজাউং’ -এর আকারে নির্মিত। ‘তাজাউং’ হল এক ধরনের বৌদ্ধ মন্দির যার বহু-স্তরযুক্ত ছাদ, চূড়ায় ওঠার সাথে সাথে ছোট হতে থাকে। ১৮৫৩ সালে, ব্রিটিশরা শহরটি দখল করার পর লর্ড ডালহৌসি যখন প্রোম পরিদর্শনে যান, তখন তিনি প্যাগোডাটি কলকাতায় স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৮৫৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজে করে এটি হুগলিতে পৌঁছয়। প্রথমে ফোর্ট উইলিয়ামে রাখা হয়। পরে গার্ডেনে স্থানান্তরিত করা হয়।১৮৫৬ সালে এক ডজন বার্মিজ কারিগর ৬ হাজার টাকায় তিন মাস ধরে বাগানে এটি পুনঃস্থাপন করেন।
যে জলাশয়টি দিয়ে প্যাগোডাটি বেষ্টিত, সেই পুকুর বা জলাশয়ের পুরোটা জুড়ে রয়েছে শালুক ফুল বা শাপলার সংসার। আপনারা জানেন কী ! একসময় এই সাদা শাপলা ফুল এত হ’ত যে বাংলাদেশের জাতির জনক জাতীয় ফুল হিসেবে শাপলাকে বেছে নিয়েছিলেন। এই উদ্যানের জলাশয়েও এর ভাসমান পাতা আর ফুলের রূপ আকৃষ্ট করবেই। এত এত সবুজ যেখানে, সেখানে তো পাখিদের আনাগোনা থাকবেই। যাদের কিচিরমিচির শুনে গোটা একটা বিকেলে দিব্যি কাটিয়ে ফেলা যায়।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বন বিভাগের উদ্যান ও কানন শাখার অধীনস্থ একটি নার্সারি রয়েছে। যেখানে সপ্তাহের সাত দিনই দশটা থেকে পাঁচটার মধ্যে গেলে দুস্প্রাপ্য নানারকম চারা গাছের খোঁজ মিলবেই মিলবে। বছরে একবার এখানে বিনামূল্যে চারাগাছও বিতরণ করা হয়।
রয়েছে বাচ্চাদের একটা পার্ক। বোটিংও করা যায়। ৮০ টাকা খরচ করলেই, পুরো জলাশয়টা আরো ভালো করে ঘুরে দেখা যাবে।
রয়েছে একটি ক্যাকটাস হাউস। এত বড় জায়গাটা ঘুরে দেখতে দেখতে খিদে পেলে, এখানে স্বল্পমূল্যে পেটপুজো সারার জন্য রয়েছে ইডেন ফুড প্লাজা। এর সামনে প্রচুর ফাঁকা জায়গা, সপরিবারে একটা পারফেক্ট ডে- আউটের প্ল্যান করাই যায়।
বাগানটির আয়তন প্রায় ১৫.৬ একর। সারি সারি নারকেল গাছ,বিস্তীর্ণ সবুজের লন, জলের ফোয়ারা, রং বেরঙের ফুল চোখ এবং মন, দু’য়ে একটা মনোরম অনুভূতির জোগান দেবেই। তাই, দেরি না করে একদিনের প্ল্যান করে ঘুরে দেখুন এই অশেষ সবুজকে।
আমরা ত্রয়ী (amra troyee) নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল এই উদ্যানটি নিয়ে চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছে। যেটি দেখে আপনারা আরো অনেক কিছু জানতে পারবেন। নীচে তাঁদের ভিডিওর লিঙ্কটি দেওয়া রইল।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: আমরা ত্রয়ী
তথ্য : গুগল
ছবি : অন্তরা ঘোষ ধর