সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের আস্বাদ গ্রহণ করতে, কয়েক ঘন্টার ঝটিকা সফরে পৌঁছে যেতে পারেন —অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাগান বাড়িতে।

সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের আস্বাদ গ্রহণ করতে, কয়েক ঘন্টার ঝটিকা সফরে পৌঁছে যেতে পারেন —অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাগান বাড়িতে। মন্দ লাগবে না !

বালি ব্রীজ হয়ে জিটি রোড। তারপর উত্তরপাড়া, ভদ্রকালী হয়ে কোন্নগর। রাস্তার ধারেই সুন্দর একটি তোরণ। গলিতে ঢোকার মুখেই রয়েছে ভুবনজয়ী চিত্রশিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবক্ষ মূর্তি।। যেন স্বয়ং পাহারা দিচ্ছেন তাঁর প্রিয় বাগানবাড়িটি। এই গলিপথ ধরে এগোলেই প্রবাদপ্রতিম কালজয়ী শিল্পীর স্মৃতিবিজড়িত বাগানবাড়ি।
কোন্নগর পৌরসভার ১৫ নং ওয়ার্ডের অন্তর্গত ২ নং মীরপাড়া লেন। লেনের দু’ধারে উঁচু পাঁচিল। পাঁচিলের গা বরাবর বিভিন্ন ধরনের গাছের সারি।  তবে, এদের কিন্তু কোনো পার্কিং নেই, তাই গাড়ি না নিয়ে যাওয়াই ভাল।
ঢুকেই ডানদিকে বেশ বড়ো একটা লম্বা দালানে কয়েকটি ছোট্ট ঘর। বিভিন্ন ছবি, গাছ দিয়ে সুন্দর করে সাজানো। ঘরগুলোর কোনোটি গ্রন্থাগার আবার কোনোটি রন্ধনশালা, অফিস ঘর।
আরো সামনের দিকে এগোলে পাওয়া যাবে বিভিন্ন ফুলের গাছ। দু’ধারে সবুজ ঘাসের গালিচা। তারমধ্যেই নানা গাছের সমাহার। পাশ দিয়েই ছান্দিক গতিতে বয়ে চলেছে হুগলী নদী। শ’দেড়েক মিটার আগেও জিটি রোডে যে নিত্য জীবনের কোলাহল, তা মুহুর্তের মধ্যেই উধাও হয়ে যাবে। হুগলী নদীর ধার বরাবর বাগানের সুসজ্জিত রাস্তা ধরে সামনে আরেকটু এগোলে পথের ধারেই পড়বে সৃজনশীল ভাবনায় গড়ে তোলা একটি ছোট্ট কুটির। কুটিরের ভিতরে শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি আবক্ষ মূর্তি রয়েছে।
সেখান থেকে আরেকটু সামনের দিকে এগোলেই শিল্পীর বাড়ি।সাদা রঙের একতলা ভবন। খড়খড়ি দেওয়া জানলা, উঁচু উঁচু খিলান, আর কড়ি-বর্গার সাবেকি ছাদ। বাড়িটিতে আভিজাত্যের ছাপ বেশ স্পষ্ট। বহু পুরানো বাড়ি। তবে এখন সংস্কার করা হয়েছে। বাড়ির মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন স্বনামধন্য শিল্পীদের আঁকা নানা চিত্র। এছাড়াও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একাধিক ছবি তো রয়েছেই।
বাড়ির সামনে দিয়ে সিঁড়ি নেমে গিয়েছে সোজা  হুগলী নদীর ঘাট পর্যন্ত। তবে, নিরাপত্তাজনিত কারণে সেই ঘাটের গেট আপাতত বন্ধ।
বাগানবাড়ির একদিকে রয়েছে একটি কৃত্রিম জলাশয়। তার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন রঙিন মাছ। তবে, শোনা এটি ছিল স্নানাগার। এখানেই সাঁতার শিখেছিলেন ছোট্ট অবন। স্নানাগারের থেকে একটু দুরেই রয়েছে একটি ছোট্ট  কুটির। তার গায়ে শিল্পী তাঁর শিল্পভাবনাকে রঙ-তুলির মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন।এখানেই নাকি থাকত অবন ঠাকুরদের ফিটন বা ঘোড়ার গাড়ি। রাখা হত পালকি।
 ছায়া সুনিবিড় বাগান বাড়ির রাস্তাটি  ভীষণ সাজানো গোছানো।  চারিদিকে মোটামুটি একটা শান্তিনিকেতনি ভাবনার প্রতিফলন বেশ স্পষ্ট। প্রবাদপ্রতিম বাঙালি চিত্রশিল্পীর যে বাড়ি থেকে আঁকায় হাতেখড়ি, সেই বাড়ি যে শিল্পের সূতিকাগার তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।
      এবার চলুন এর ইতিহাসটা ঘেঁটে দেখি ! জানা যায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের কেনা অজস্র জমিদারির মধ্যে একটি অংশ ছিল কোন্নগরের হুগলী নদী তীরবর্তী এই বাগানবাড়ি। কোন্নগরের এই বাগানবাড়ি তাঁর মধ্যমপুত্র গিরীন্দ্রনাথের ভাগে পড়েছিল। গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর উত্তরাধিকার সূত্রে এই বাগানবাড়িটি পান। গুণেন্দ্র পুত্র অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাঝেমধ্যেই ছোটোবেলায় এই বাড়িতে ছুটি কাটাতে আসতেন। এখানেই তাঁর শিল্পীজীবনের হাতেখড়ি। শিল্পী তাঁর আত্মজীবনী ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’তে লিখেছেন,”কোন্নগরে কী আনন্দেই কাটাতুম।…সেই সেবার কোন্নগরে আমি কুঁড়েঘর আঁকতে শিখি…”।
শিল্পীর শৈশব জীবনের একটা বড়ো অংশ এই বাগানবাড়িতে কেটেছে। বহু প্রাতঃস্মরণীয় ও বরণীয় ব্যক্তিত্ব এখানে এসেছেন। গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আকস্মিক মৃত্যুর পর বাগানবাড়ি ছেড়ে কোলকাতায় চলে যান অবন ঠাকুর ও তাঁর পরিবার।
 ১৯৪৪ সালের ১৬ ই জানুয়ারী এই বাগান বাড়িটি পুলিনকৃষ্ণ রায় নামক জনৈক ব্যক্তির নামে পৌরসভার রেকর্ডে নথিভুক্ত হয়। তারপর কালের নিয়মে একসময় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংস হতে বসে ভুবনজয়ী শিল্পীর স্মৃতিধন্য বিভিন্ন সামগ্রী ও তাঁর বাসভবন।২০০৭ সালে এই বাগানবাড়িকে হেরিটেজ ভবন হিসাবে ঘোষণা করেন হেরিটেজ কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. প্রতাপ চন্দ্র। তারপরও এই বাগানবাড়িতে বহুতল ভবন নির্মাণের চেষ্টা করে একটি বেসরকারি বহুতল নির্মাণকারী সংস্থা। বিষয়টি আদালতে যায়।অবশেষে ২০১৯ সালের ৫ ই মার্চ এই জমির মূল অংশ কোন্নগর পৌরসভাকে হস্তান্তর করে ওই বেসরকারি বহুতল নির্মাণকারী সংস্থা। তারপরই শুরু হয় নতুন করে অবন ঠাকুরের বাগানবাড়িকে সাজানোর প্রক্রিয়া। কোন্নগর পৌরসভার উদ্যোগে নতুন ভাবে, নতুন রূপে সংস্কারের পর ২০২০ সালের মার্চ মাসে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত এই বাগানবাড়ি পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
বর্তমানে বাগানবাড়িটিকে কোন্নগর পৌরসভাই দেখাশোনা করে। প্রতি সোমবার বাগানবাড়িটি পর্যটকদের জন্য সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। বাকি সবদিন সকাল ১০ টা থেকে – বিকেল ৫ টা পর্যন্ত পর্যটকদের জন্য খোলা থাকে। প্রবেশমূল্য ১০ টাকা। ঐতিহ্যবাহী এই বাগানবাড়ির ভিতরে টয়লেট, বা পানীয় জলের ব্যবস্থাও রয়েছে।  সমগ্র বাগানবাড়িটি সিসিটিভি ক্যামেরার আওতাধীন। রয়েছে শিশুদের জন্য দোলনা, স্লিপ সহ বিভিন্ন খেলার সামগ্রী। তাই বাচ্চাদের নিয়ে এলে তাঁরাও বেশ মজাই পাবে ।
 কলকাতা থেকে খুব সহজেই আসা যায় হুগলি জেলার কোন্নগর ২ নম্বর  মীর পাড়া লেনে অবস্থিত অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাগান বাড়িতে। নিজেদের গাড়িতে এলে তো জি পি এস রয়েছে। আর নয়ত হাওড়া থেকে লোকাল ট্রেনে ৬ নম্বর স্টেশন কোন্নগর। স্টেশন থেকে টোটো বা অটো ধরে সোজা বাগানবাড়ি। এছাড়াও সড়কপথে জিটি রোডের ওপর মীর পাড়া বাস স্টপেজে নামলে চোখে পড়বে সেই পুরোনো গলি। সপ্তাহান্তে কাছেপিঠে বেড়ানোর পারফেক্ট জায়গা বলা যায়।
Facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmail

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *